৮ এমপিকে এক বছরে হারাল জাতীয় সংসদ
সময়ের কাঁটা ঘুরে বিদায় নিচ্ছে আরও একটি বছর। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অনেক হারানোর বছর ২০২০। এ বছর দেশের দুজন সংসদ সদস্য (এমপি) করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। এছাড়া বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছেন আরও ছয় এমপি।
এদিকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ (এমপি নন) করোনায় মারা যান। করোনার কারণে পাঁচজন এমপি সংসদে জানাজাও পাননি। ঠিকভাবে চালানো যায়নি সংসদীয় কার্যক্রম। অধিবেশন ছিল শুধু সংবিধান রক্ষার জন্য। অন্যদিকে সংসদীয় কমিটিগুলোও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী বৈঠক করতে পারেনি।
বিদায়ী বছরে মৃত আট এমপির মধ্যে দুজন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের। এ স্বল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক এমপি হারিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের বিভিন্ন নেতা।
এতসংখ্যক এমপির মৃত্যুতে করোনার কারণে এ বছর উপনির্বাচন করতেও দেরি হয়েছে। দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি শূন্য থেকেছে সংশ্লিষ্ট আসনের জনগণ। করোনার কারণে তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাসের মধ্যে এসব আসনে উপনির্বাচন হয়।
সংসদের আইন শাখা-২ সূত্র জানায়, গত ১০ জানুয়ারি ডা. মোজাম্মেল হোসেন (বাগেরহাট-৪), ১৮ জানুয়ারি আব্দুল মান্নান (বগুড়া-১), ২১ জানুয়ারি সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও এমপি ইসমাত আরা সাদেক (যশোর-৬), ২ এপ্রিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু (পাবনা-৪), ৬ মে হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫), করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৩ জুন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এমপি (সিরাজগঞ্জ-১), ১০ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮) ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২৭ জুলাই ইসরাফিল আলম (নওগাঁ-৬) মারা যান।
এ বিষয়ে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘বিদায়ী বছরে আমরা অনেক এমপি হারিয়েছি। এজন্য সংসদের কার্যদিবসগুলোও ছিল শোকাচ্ছন্ন। করোনাভাইরাসের কারণেও অধিবেশনের কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। মানা হয়েছে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি।’
কোনো এমপি মারা গেলে সংসদে অনুষ্ঠিত জানাজায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ছাড়াও নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সম্মান জানানো হয়।
মুক্তিযোদ্ধা হলে পান গার্ড অব অর্নার। জানাজায় সহকর্মীরা ছাড়াও সংসদে কর্মরত ও আশপাশ এলাকায় বসবাসকারীরা অংশ নেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পাঁচজন এমপির ভাগ্যে এসব জোটেনি।
দলের একের পর এক এমপি মারা যাওয়ায় জুনে সংসদে অশ্রুসিক্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুব দুঃখজনক… আসলে আমার জন্য খুব কষ্টকর হচ্ছে বলতে, এভাবে সবাইকে হারানো খুবই দুঃখজনক।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বার বার চোখ মোছেন শেখ হাসিনা।
সংক্ষেপে বিদায়ী বছরে জাতীয় সংসদের কার্যক্রম
>> ২০১৯ সালে পাঁচটি অধিবেশনের ৬১টি কার্যদিবস ছিল। বিল পাস হয় ১৯টি। কিন্তু বিদায়ী বছরের (২০২০) পাঁচটি অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৫৩টি। বিল পাস হয়েছে ২৭টি। এ বছর সংসদের কার্যদিবস কম থাকলেও বিল পাসের সংখ্যা বেশি।
>> বিদায়ী বছর প্রথম এবং একাদশ জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশন ৯ জানুয়ারি শুরু হয়। এর কার্যদিবস ছিল ২৮টি। বিল পাস হয়েছে ৭টি।
>> ২২ ও ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হলেও করোনাভাইরাসের কারণে তা স্থগিত করা হয়।
>> বছরের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১৮ এপ্রিল। এ অধিবেশনের কার্যদিবস ছিল মাত্র একটি। এই অধিবেশনে কোনো বিল পাস হয়নি। করোনার কারণে অধিবেশন থেকে সাংবাদিকদের সংসদে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন সবকিছু আগের নিয়মে চললেও ‘রহস্যজনক’ কারণে সংসদে অধিবেশন চলাকালীন সাংবাদিকরা যেতে পারেন না।
>> বছরের তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় ১০ জুন। এটি ছিল বাজেট অধিবেশন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণেও এটি সংক্ষিপ্ত করে মাত্র ৯ কার্যদিবস চলে। বিল পাস হয় পাঁচটি।
>> বছরের চতুর্থ অধিবেশন ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। এর কার্যদিবস ছিল পাঁচ দিন। বিল পাস হয় ছয়টি।
>> বছরের শেষ অধিবেশন শুরু হয় ৮ নভেম্বর। কার্যদিবস ছিল ১০টি। এ অধিবেশনে ৯টি আইন পাস হয়েছে। এই অধিবেশনের দুটি কার্যদিবস বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
সংসদ কক্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ এটাই সংসদের প্রথম বিশেষ অধিবেশন। এর আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব পাসের সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অধিবেশন কক্ষে শোনানো হয়েছিল। জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সংসদ লেকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন দুটি নৌকা ভাসানো হয়, যা তৈরি করতে ব্যয় হয় ৪০ লাখ টাকা।
বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষে গত ৯ নভেম্বর অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে স্মারক বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে সংসদে একটি প্রস্তাব আনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই প্রস্তাব নিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতাসহ সরকারি ও বিরোধীদলীয় ৭৯ সংসদ সদস্য এর ওপর ১৯ ঘণ্টা ৩ মিনিট আলোচনা করেন। ১৫ নভেম্বর সংসদে সেই প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়।
এরপর দিন থেকে সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিদায়ী বছরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০ পাস হয়।
বিদায়ী বছর সংসদের কার্যক্রম মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু আমরা সংবিধানের বাইরে যাইনি। স্বল্প পরিসরে হলেও অধিবেশন বসেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশন। এ অধিবেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল।